. #বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান পানিতে দ্রবীভূত হওয়ার ফলে, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO)এর পরিমাণ হ্রাস ঘটানোই হচ্ছে পানি দূষণ।পানির গুণাগুণ নির্ধারনে DOএর মান খুবই গুরুত্বপূর্ন।এ মান 4-6ppmহওয়া প্রয়োজন।DOমান হ্রাসের ফলে জলজ প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হয় এবং পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক বর্জ্য পানিতে মিশে পানির দূষণ ঘটায়।
১#শিলপজাত বর্জ্য : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ।এরুপ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিল্পের প্রসার না ঘটলেও শিল্পকারখানা হতে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য পূর্ব শোধনের সীমিত ও দুর্বল ব্যবহারের কারণে পানিকে মারাত্মক ভাবে দূষণ করে। গত দুই তিন দশকে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে নরসিংদী, গাজীপুর, সাভারে গড়ে উঠা ডায়িং শিল্পের বর্জ্য যে কিভাবে পানি দূষণ করছে,তা না দেখলে বুঝার উপায় নাই।এসব শিল্প হতে নির্গত বর্জ্যের মধ্যে pb ,Cd,As,Cr এর মত ক্ষতিকর ধাতু পানির DO হ্রাস করে পানিকে দূষিত করে ।
২#ই বর্জ্য: বিষাক্ত ই বর্জ্যের ভাগার হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলো।বিশ্বে এখন কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যে গতিতে হচ্ছে,সে অনুপাতে বাড়ছে ই বর্জ্য। নতুন প্রযুক্তি গুলো দ্রুত চলে আসায় আগের ইলেকট্রনিক সামগ্রী গুলো ফেলে দেয়া হচ্ছে। কম্পিউটার, সেল ফোন, টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, সোলার এনার্জির ব্যাটারি, ফটোকপিয়ার, ডিভিডি প্লেয়ার সহ হরেক রকমের দ্রব্য সামগ্রী, দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বেশির ভাগ ব্যবহারকারীই জানেন না এই সব পন্যের আয়ুষ্কাল শেষ হবার পর অতি শখের এ পন্নটির বর্জ্যই তার জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠবে।এ ব্যবহার অযোগ্য ইলেকট্রনিক্সে থাকে ক্যাডমিয়াম (Cd), ক্রোমিয়াম (Cr), সীসা (Pb), আর্সেনিক (As)এর মতো বিষাক্ত ভারী ধাতু এ ইলেকট্রনিক্সের ধ্বংসাবশেষ থেকেই বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক ভাবে।
৩) গৃহস্থালির বর্জ্য: গৃহস্থালির কঠিন ও তরল উভয় প্রকারের বর্জ্য দ্বারা পানির দূষণ ঘটে। পৌর এলাকার নালা নর্দমার পানি, হাসপাতালের বর্জ্য, রান্না ঘরের ধৌত পানি সরাসরি জলাশয় বা নদীতে মিশে পানির দূষণ ঘটায়।এ পানি ব্যবহারের ফলে কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস ইত্যাদি রোগের সংক্রমণ ঘটায়।
৪)পয়ঃবর্জ্য: পয়ঃবর্জ্য মারাত্মকভাবে পানির দূষণ ঘটায়। প্রতিটি পৌর এলাকার পয়ঃবর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদী নালার পানিতে মিশে দূষণ ঘটায়।
৫) কৃষিক্ষেত্রে:কৃষি জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন ও ফসল সংরক্ষনের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। বৃষ্টি,সেচ,বা অন্য কারনে জমিতে প্রয়োগকৃত এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ধুয়ে নদী বা অন্যান্য জলাশয়ে মিশে পানির দূষণ ঘটায়। বিশেষ করে ইউরিয়া পানিতে আর্দ্র বিশ্লেষিত হয়ে NH3 ওCO2 উৎপন্ন করে। H2N-CO-NH2 +H2O=2 NH3. +CO2
৬) কিছু ভারী ধাতুর খাদ্য শৃঙ্খলে যুক্ত হওয়া: প্রথম যে নামটি আমাদের মনে আসে, সেটি হচ্ছে আর্সেনিক। খাদ্য শৃঙ্খলে As এর দূষণ অনেকটাই প্রাকৃতিক নিয়মে হয়ে থাকে।As এর বিভিন্ন খনিজ ভূগর্ভস্থ পানির মধ্য দিয়ে প্রবেশের সময় As3+ ও As5+ জারন অবস্থার সৃষ্টি করে ,এসব কনা পানিতে দ্রবীভূত হয়। ভূগর্ভস্থ এ দূষিত পানি উত্তোলন করে কৃষি কাজে ব্যবহারের ফলে, বিভিন্ন শস্য বীজের মধ্যে অধিশোষন ও এনজাইম ক্রিয়া ঘটে শস্য বীজে জমা হয় এবং পরে তা জীবের দেহে প্রবেশ করে।WHO এর মতে As এর নিরাপদ মাত্রা 0,01-0,05 ppm।
As দূষণ যুক্ত পানি পানে ব্লাকফুট ডিজিজ, ফ্যাটি লিভার, ফুসফুস ক্যান্সার,স্কিন ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি বিকল, ইত্যাদি মারাত্মক রোগ হতে পারে।
আর একটি খারাপ ধাতু Cr খাদ্য শৃঙ্খলে যুক্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান উৎস হলো ট্যানারি শিল্প বর্জ্য।এ শিল্পে ক্রোম ট্যানিঙ এর সময় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ Cr2( SO4)3 ব্যবহ্র্ত হয়।
এ শিল্পের বর্জ্য পানিতে মিশে এটি পরিবেশে চলে আসে। বস্ত্র শিল্পের কাপড়ের উপর প্রিন্টিং এর কাজে ক্রোম অ্যালাম কে ব্যবহার করা হয়।এ থেকেও Cr পরিবেশে মিশে থাকে।এর প্রভাবে পরিপাকতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র, প্রজনন তন্ত্র, রোগপ্রতিরোধ সিস্টেম ইত্যাদি আক্রান্ত হতে পারে এবং এর প্রভাবে রক্ত শুন্যতা, চর্মরোগ হতে পারে।
লেড একটি ক্ষতিকর ভারী ধাতু। খনিতে গ্যালেনা (pbs) হিসেবে একেপাওয়া যায়।এ আকরিক থেকে লেড ধাতু নিষ্কাশনের সময় বর্জ্য হিসেবে pb ধাতু পরিবেশে নির্গত হয়। এছাড়া শিল্পক্ষেত্রে, কীটনাশক,পাইপ তৈরি,সঙ্করধাতু তৈরির সময় বর্জ্য হিসেবে লেড ধাতু পরিবেশে মিশে থাকে। এটি শরীরে প্রবেশ করলে বমি বমি ভাব, ক্ষুধা মন্দা, অনিদ্রা, মাথা ব্যথা, শিশুদের IQ হ্রাস পায়।
খাদ্য শৃঙ্খলে Cd ধাতু সংক্রমণের অন্যতম উৎস হলো,আকরিক থেকে Zn,Cu,Pb প্রভৃতি নিষ্কাশনের সময় আকরিকের মধ্যে ভেজাল Cd ধাতু শিল্প বর্জ্য হিসেবে পরিবেশে চলে এসে Cd2+ আয়ন হিসেবে পানি, মাটি, উদ্ভিদ হয়ে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে।এ ছাড়া রঙিন কাঁচ, কাপড়, কাগজ রাবার,ছাপার কালি,PVC প্লাস্টিক এসব শিল্প ক্ষেত্রে Cd ও তার যৌগ ব্যাবহারের কারনে কোন না কোন ভাবে তা পরিবেশে গিয়ে মিশে।এর প্রভাবে অস্হি কাঠামোর বিশেষ রোগ ইটাই-ইটাই,অষ্টিওপোরোসিস,পোষ্টট ও ফুসফুস ক্যান্সার এর মতো ঘাতক ব্যাধি হতে পারে। নিম্নে পানি দূষণের এমন কিছু চিত্র দেখা যাক।
জনসচেতনতা: বিশেষ করে জলাধারের পাশে মলমূত্র ত্যাগ না করা এবং রোগীর জামা কাপড় পুকুর বা নদীতে না ধোঁয়া,হাসপাতাল বা ক্লিনিকের বর্জ্য নদীর পানি বা জলাশয়ে না ফেলা, পুকুরে বা নদীতে পশু গোসল না করানো, গৃহস্থালির ময়লা নদীর পানিতে না ফেলা,এসব সচেতনতা মূলক বিষয় গুলোকে সমাজের উঁচু স্তর থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সকলকে অবহিত করে তা মেনে চলার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা অতি জরুরী যা আমরা চিত্রে দেখতে পাচ্ছি।
পানির অপচয়:: পানির অপচয় বিষয় টি আমাদের জনজীবনে একটি গভীর সমস্যা ও ভবিষ্যতের জন্য বিরাট হুমকি। চাষের জমিতে এমন দৃশ্য প্রতিনিয়ত দেখা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সময় ডিপ টিউবওয়েল ছেড়ে রাখা, রাস্তার পাশের পৌরসভার কলগুলোর ট্যাপের মুখ খুলে রাখা অথবা বাসা বাড়িতে অপ্রয়োজনীয় ভাবে পানি নষ্ট করা।একটু ভেবে দেখুন এ পানি আমাদের অমূল্য সম্পদ। অযথা পানি এভাবে নষ্ট হতে থাকলে পানির স্তর যদি অনেক নীচে নেমে যায়, তবে কোথায় পাব আমরা খাবার পানি বা চাষাবাদের পানি।এ ব্যাপারে সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন জরুরী, বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে বন্ধুরা তোমাদের মতামত কমেন্ট বক্সে জানাও।সবার মঙ্গল ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি।
বল্গারের, বাস্তবধর্মী ও সমসাময়িক একটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কেননা, পানি দূষণ ও অপচয় রোধের জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে।
নিরাপদ পানি সংরক্ষণে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগের বিকল্প নেই।